রাতের ছায়া
রাত তখন আড়াইটা। গ্রামের বাড়িগুলো সবাই নিদ্রায় ডুবে আছে — জানালার পর্দা টেনে, খাটের মধ্যে সারা শরীর মুড়ে থাকা মানুষগুলো মনে করে তারা নিরাপদ। সেই গ্রামেই ছিল লাজু, একা এক ছোট্ট কুটিরে থাকত সে। লাজু কখনো বাইরে রাতে বেরত না, তবু ওই রাতটা ওর জন্য আলাদা। কারণ — তিন দিন ধরে গ্রামের কয়েকজন বলছিল মৃতদের কাঁপানো কান্না শোনা যাচ্ছে কবরস্থানের গাছতলার নিচ থেকে। লোকেরা বলত: “শব্দটা জোড়, মানুষের মতো না, যেন হাজার বছর ধরে চাপা পড়া শ্বাস নিচ্ছে।”
লাজুর কাছে এসব ছিল লোককথা—হাস্যকর গল্প। কিন্তু আজ রাতটা অদ্ভুতভাবে শান্ত নয়। ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পেঁপে গাছের পাতা যেন হঠাৎ করে ফিসফিস করে উঠল, এমন শব্দ যা বাতাস থেকেই আসা হওয়া সম্ভব নয়। লাজু মোমবাতি হাতে নিয়ে দরজার আগেই দাঁড়িয়ে ভাবল — কে জানে, নাকি সত্যিই কবরস্থানের খোঁপা থেকে কাচাঙ্কিত আওয়াজ আসে?
তার কিশোর আছে এতটুকু সাহস, সে মোমবাতি নিয়ে কবরস্থানের দিকে হাঁটল। রাস্তা একেবারে খাঁটা—নভু আকাশে মেঘ জমে আছে, চাঁদ আড়াল। কবরস্থানের প্রবেশদ্বারটা গলায় কাঁটা-ভরা লোহার বেড়া, মুখোশ আর ধুলো। লাজুর মাথায় এক ভয়ের কুয়াশা, কিন্তু কৌতূহল কাঁধে ওঠে। সে ভেতরে প্রবেশ করে—কংক্রিটের চিহ্ন, ভাঙা পাথর, পুরোনো কবর-চিহ্নগুলো আঁধারের মধ্যে ভাসে মোমবাতির জ্বালায়। বুকে অচেনা একটা উষ্ণতা-শীতলতার মিশ্র অনুভূতি।
হঠাৎ—মোমবাতির শিখা হঠাৎ নাচতে শুরু করল। বাতাস নেই। পাতা মেলছে না। তবু শিখার নাচে মনে হল কেউ কোনো এক প্রাচীন সুরে গলা মেলে। লাজু থেমে দাঁড়াল। দূরে একটা কবরের ওপর অজানা ছায়া কালো কুঁচকায় বিকটভাবে নড়ল। লাজু হাত ছিল যখন, সঙ্গে ছিল না শব্দ—কেবল মোমবাতির টুংকার। ছায়াটা ধীরে ধীরে উঠল, কবরের ধার ভাঙিয়ে, মাটির মধ্য থেকে যেন ধোঁয়াটে হাহাকার করে উঠে আসছে।
তার আগে লাজু কখনো এমন আওয়াজ শুনেনি—একটা লম্বা, কণ্ঠহীন আর খাঁ খাঁ করে যেন কাঁদছে। শব্দটা বায়ুতে ভেসে গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল—একটানা, ছিন্নভিন্ন। লাজু পা ফেলল পেছনে, মোমবাতি ফেলতে চাইল—কিন্তু সে হঠাৎ দেখল মোমবাতির আলোই যেন আটকে গিয়েছে, কোনো অদৃশ্য হাত আলোকরশ্মিকে চেপে ধরেছে। ছায়াটা সে দিকে ঘুরল, আর তখন লাজু দেখল—তার নিজের চেহারা কবরের ছায়ার ভেতর। কিন্তু তার চেহারা ভুল—চোখ গহ্বর শুন্য, মুখ থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে, আর মুখের কোণা হাঁটুর মত কেঁপে আছে।
লাজু চমকে চিৎকার করতে চাইলে কানে আচমকা টুনি গানের মতো শব্দ কেঁপে উঠল—“তুমি এখানে কাঁধে বয়ে নিয়ে এসো।” শব্দটা যেন মাটির নীচ থেকে উঠছে, ক্ষুদ্রকণার মতো, কিন্তু সামনে থেকে আছড়ে পড়ছে।
লাজু চুপ হয়ে গেল। হঠাৎ অনুভব করল—তার শরীর ভারী হয়ে গেছে, পা মাটিতে গাঢ় ঢুকে যাচ্ছে, ঠিক যেন কেউ পায়ের সঙ্গে জড়িয়ে ধরেছে। সে চুষ্ঠি করে কাঁধের ওপর হাত দিল—চোখ ফেটে জানান দিল কাঁধে কান্ডা ধরেছে এক ঠাণ্ডা জিনিস। আলো—না, ছায়ার ভেতর থেকে একটা ছোট হাত বেরিয়ে এসে ধাক্ করে লাজুর কাঁধে জবরদস্তি করে লেগে আছে। হাতটি ঠান্ডা নয়—অতি ব্যথাময় শুষ্ক। লাজুর গলা শুকিয়ে গেল, মুখে শব্দ নামল না। হাতটি নাড়ল—নড়াচড়া করল—আর তার ভেতরে ধীরে ধীরে গাঢ়, কুঁচকে ওঠা একটা মুখ খেলে উঠল, মুখটা বলল না, কিন্তু লাজু বুঝতে পারল: “আমাকে ফিরিয়ে দাও।”
… (গল্পের বাকি অংশও একইভাবে
ট্যাগের মধ্যে রাখতে পারেন) …


0 মন্তব্যসমূহ